সহানুভূতি

সহানুভূতি

সহানুভূতিশীল এবং দয়ালু, জনগণের প্রয়োজনে তৎপর এবং ভিন্নমত ও বিশ্বাসে সহনশীল।

সহানুভূতি হল অন্যের অনুভূতি, প্রয়োজন এবং পরিস্থিতি উপলব্ধি ও সেগুলির প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার ক্ষমতা। এই গুণটি একজন নেতাকে মানবিক এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। সহানুভূতিশীল নেতারা মানুষের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন, বিশেষ করে দুর্বল এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটাতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন।

আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, "আমি সবসময় দেখেছি যে, কঠিন বিচার অপেক্ষা ক্ষমা অধিক মিষ্ট ফল দেয়।" জ্যাক ওয়েলচের মতে, "নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহানুভূতি তথা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বইয়ের জ্ঞান থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।" তাই একজন প্রকৃত নেতা হওয়ার জন্য সহানুভূতির প্রয়োজন, যা অন্যের প্রয়োজন এবং কষ্ট বোঝার ক্ষমতাকে বাড়ায়।

সহানুভূতিশীল নেতা চেনার উপায়:

  • তিনি কি অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেন?
  • তিনি কি অন্যদের অনুভূতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার আন্তরিক চেষ্টা করেন?
  • তার অন্যদের আবেগ বোঝার ও প্রতিফলিত করার ক্ষমতা আছে কিনা?
  • তিনি কি অন্যদের জায়গায় নিজেকে রেখে পরিস্থিতির বিচার করতে পারেন?
  • তিনি কি নিজের আবেগকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? এক্ষেত্রে তিনি কি অন্যদের সাথে আচরণ ও কথোপকথনে আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন?
  • তিনি কি অন্যদের আবেগে সহমর্মিতা প্রদর্শন করেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সমর্থন ও সহযোগিতা করেন?
  • সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এবং অন্যদের সাথে কথোপকথনে তিনি কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন?
  • তার শরীরী ভাষা ও মুখাবয়বে কি অন্যদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পায়?
  • তিনি কি ভিন্ন মতামতের প্রতি সহনশীল?

"সহানুভূতি হল অন্য ব্যক্তির মধ্যে নিজের প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়া।" — মোহসিন হামিদ


নেতৃত্বে সহানুভূতির উদাহরণ:

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে: রাজা রামমোহন রায়
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক, যিনি ১৯শ শতকে ভারতীয় সমাজে আধুনিক ভাবনা ও সংস্কারের প্রবর্তক। তাঁর সহানুভূতি শুধুমাত্র একটি নৈতিক গুণ নয়, বরং এটি তাঁর কাজের মৌলিক ভিত্তি ছিল। তিনি সমাজের অসঙ্গতি ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে, তিনি যেভাবে সমাজের অবহেলিত শ্রেণির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন তা তাঁর কাজের কেন্দ্রে ছিল। 
রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগগুলোতে মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি বিধবা বিবাহ ও নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা চালিয়ে সমাজের অবহেলিত শ্রেণির অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তাঁর উদ্যোগে, যেমন সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা, এই সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর প্যাথোস এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। তিনি জানতেন যে নারীদের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে পুরো সমাজ উন্নত হবে। তাঁর প্রচেষ্টা শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং গোটা সমাজের উন্নয়নের জন্য ছিল। তাঁর কর্মকা–গুলি আজও প্রাসঙ্গিক, এবং তিনি ভারতের সমাজ সংস্কারক হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে: ইয়াসির আরাফাত
ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের নেতা হিসেবে, ইয়াসির আরাফাত তাঁর জনগণের দুর্দশা বোঝার জন্য গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একটি জাতির পরিচয়, মর্যাদা, এবং অধিকার শুধুমাত্র তাদের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। তাঁর সহানুভূতি তাঁকে উৎসাহিত করেছিল তাঁদের অধিকারের জন্য নিরন্তর লড়াই করতে।
ডেইজ অব রেজিস্টেন্স (১৯৭৯) বইয়ে তিনি ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন, যা তাঁর জনগণের প্রতি গভীর সহানুভূতির পরিচায়ক। তাঁর লেখা সমাজের মানবিক দিকগুলোকে তুলে ধরে এবং ফিলিস্তিনিদের সমস্যার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। তাঁর নেতৃত্বে, তিনি সহানুভূতির মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, যা ফিলিস্তিনিদের ন্যায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর অবদান শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং একটি মানবিক সংগ্রামের উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে: সালাহউদ্দিন আইউবি
সালাহউদ্দিন আইউবি, একজন সম্মানিত নেতা ও সেনাপতি, ছিলেন মানবতার জন্য পরিচিত। তিনি শত্রুর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য খ্যাত ছিলেন। তাঁর সহানুভূতি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ ছিল, যা তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করেছিল।
১১৮৭ সালে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের পর, সালাহউদ্দিন বন্দীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন এবং নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। তিনি শত্রুদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাদের অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দেন। Saladin: The Life, the Legend and the Legacy (২০১৩) বইয়ে তাঁর ন্যায়বিচার ও সহানুভূতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা তাঁর মানবিকতার উদাহরণ হিসেবে প্রশংসা পেয়েছে। সালাহউদ্দিনের এই গুণ শুধু যুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়, বরং তাঁর প্রশাসনিক নীতির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছিল, যা সমগ্র অঞ্চলকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছিল। তাঁর শাসনকালে, তিনি ধর্ম, জাতি এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের অধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। তাঁর উদাহরণ মানবতার প্রতি গভীর সহানুভূতির একটি চিরন্তন মডেল হিসেবে কাজ করবে।

উদ্ধৃতি:

আরবি (কুরআন):
إِنَّمَا يُؤْمِنُ أَخَوَةٌ[Surah Al-Hujurat, 49:10]
("Indeed, the believers are brothers." – Quran, 49:10)

হিব্রু (বাইবেল):
אֲשֶׁר יָכוֹל לִפְרֹשׂ כַּנָּף[Psalm 91:4]
("He who can extend his wings." – Bible, Psalm 91:4)

হিব্রু (তোরাহ):
וְעָשִׂיתָ יָשָׁר וָטוֹב[Deuteronomy 6:18]
("And you shall do what is right and good." – Torah, Deuteronomy 6:18)

সংস্কৃত (গীতা):
सर्वेभ्यः प्रियं वदेत्[Bhagavad Gita, 17:15]
("Speak kindly to all." – Gita, Chapter 17:15)