ধৈর্যশীল, প্রতিশ্রুতিতে বদ্ধপরিকর এবং সংকল্পের সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম।
ধৈর্য হল মানসিক স্থিতিস্থাপকতার একটি রূপ যা একটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জের সময় শান্ত এবং স্থিতিশীল থাকতে সহায়তা করে। এটি কঠিন পরিস্থিতিতে ব্যথা, হতাশা বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার এবং সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করার ক্ষমতা। এই গুণটি বিপর্যয়ের মধ্যে শক্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, "আমি শিখেছি যে সাহস মানে ভয়ের অভাব নয়, বরং তার বিরুদ্ধে জয়। একজন সাহসী ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি ভয় অনুভব করেন না, বরং যিনি ধৈর্যের সাথে সেই ভয়কে জয় করেন।" চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধৈর্যের চেয়ে কার্যকরী আর কোনো উপায় নেই।
কনফুসিয়াস বলেছিলেন, "যত ধীর গতিতে আপনার অগ্রগতি হচ্ছে, যতক্ষণ আপনি থামছেন না, তাতে তা গুরুত্বপূর্ণ।" এই উদ্ধৃতিটি ধৈর্য এবং অবিচলতার গুরুত্বকে হাইলাইট করে, যা সফল নেতার জন্য অপরিহার্য।
ধৈর্যশীল নেতাকে চিহ্নিত করার উপায়:
নেতৃত্বে ধৈর্যের উদাহরণ:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে: কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং সমাজ reformer, যিনি নির্যাতিত এবং নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। ১৯২০-এর দশকে, তিনি তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গান লিখে সোচ্চার হন।
কাজী নজরুল তার কবিতা ও গান যেমন “ধর্মের নামে,” “বিদ্রোহী” (১৯২১), এবং “বাঙালি” (১৯৪২) এর মাধ্যমে ধৈর্যের উদাহরণ স্থাপন করেছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সময়, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময়, তিনি মানবতার পক্ষ নেওয়ার জন্য সাহস ও ধৈর্য দেখিয়েছেন। তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তিনি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সাহসী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁর কবিতা এবং গানগুলি মানুষকে সংগ্রামের জন্য উদ্দীপিত করেছে, এবং কাজী নজরুলের ধৈর্য ও দৃঢ় সংকল্পের ফলস্বরূপ, তাঁর কাজগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে: আব্রাহাম লিংকন
এই গুণটি কেন তার মধ্যে ছিল: আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট এবং মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। তিনি বর্ণবাদ ও দাসপ্রথার অবসানের জন্য যে ধৈর্য এবং সংকল্প দেখিয়েছেন, তা তাঁকে একজন উল্লেখযোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
লিংকন ছিলেন একজন অবিচল নেতা, যিনি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও কখনো হাল ছাড়েননি। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে মোট ৮টি নির্বাচন হেরেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৮৫৮ সালে স্টেফেন ডগলাসের বিরুদ্ধে সেনেটর নির্বাচনে পরাজয়। সেই সময় লিংকন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ছিলেন এবং রাজনৈতিক উত্থানের জন্য তার প্রচেষ্টায় এটি একটি বড় ধাক্কা ছিল। কিন্তু তিনি এই পরাজয়ে হতাশ হননি। বরং, তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের প্রতি অটল থেকেছেন, যা তাঁকে পরবর্তী নির্বাচনে শক্তিশালীভাবে ফিরে আসতে প্রেরণা দিয়েছে।
লিংকনের জন্য, তার লক্ষ্য ছিল একটি জাতি গঠন করা যেখানে সকল মানুষের সমান অধিকার থাকবে। ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে, তিনি আমেরিকার ইতিহাসের একটি অত্যন্ত কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বের সময়, যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হয় এবং তিনি জাতিকে একত্রিত করতে এবং মানবিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
১৮৬৩ সালে তিনি "গেটিসবার্গের বক্তৃতা" প্রদান করেন, যেখানে তিনি জাতির একাত্মতা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি "মুক্তির ঘোষণাপত্র" প্রকাশ করেন, যা দাসপ্রথার অবসান ও মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
লিংকনের ধৈর্য ও সংকল্পের উদাহরণ আজও আমাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যদি আপনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিষ্কার থাকে, তাহলে কঠিন পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব। তাঁর জীবন এবং নেতৃত্বের কাহিনী আমাদের শেখায় যে, হারানো শুধু একটি পদক্ষেপ, বিজয়ের পথে চলার একটি অংশ।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে: নবী আইউব
নবী আইউব ছিলেন একজন অত্যন্ত ধৈর্যশীল নবী, যিনি তাঁর জীবনে বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল একটি ধৈর্যের অসাধারণ উদাহরণ, যেখানে তিনি দুনিয়ার সবকিছু হারানোর পরও আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাসকে অবিচল রেখেছিলেন
কুরআন এবং বাইবেলে নবী আইউবের ধৈর্য ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাস অনুযায়ী, তিনি তাঁর পরিবার, স্বাস্থ্য, এবং সম্পদ সবকিছুই হারিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কখনও আল্লাহর প্রতি অভিযোগ করেননি। বরং, তিনি কষ্ট সহ্য করে বলেছিলেন, "আল্লাহই আমার ক্ষতি করেছেন," যা তাঁর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং ধৈর্যকে নির্দেশ করে।
নবী আইউবের কাহিনী থেকে জানা যায় যে, তিনি দীর্ঘকাল ধরে কঠিন রোগে ভুগেছেন এবং তাঁর দেহের সমস্ত অংশে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তবুও, তিনি তাঁর বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন। তাঁর ধৈর্য ও আন্তরিকতা এতটাই প্রশংসনীয় ছিল যে, আল্লাহ তাঁর সংকল্প ও ধৈর্য দেখার পর তাঁকে সুস্থ করে দেন এবং তাঁর পূর্বের সমস্ত সম্পদ ফিরিয়ে দেন।
কুরআনে বলা হয়েছে: “আল্লাহ বলেন: ‘আমার দাস আইউবকে মনে রেখো, যখন সে তার প্রভুর কাছে ডাকল, যে, আমি কষ্টে পড়েছি, এবং তুমি সবচেয়ে রহমতকারী।” (সুরা সাদ, 38:44)
আইউবের এই কাহিনী আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সত্যিকার ধৈর্য এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সব কষ্টের সময়ে আমাদের সহায়ক হয় এবং এটি আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাঁর জীবনের উদাহরণ আমাদেরকে শেখায় যে, বিপদ-আপদ আসলেও, আমাদেরকে স্থির ও ধৈর্যশীল থাকতে হবে।
উদ্ধৃতি:
আরবি (কুরআন):
إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ – [سورة البقرة، ٢:١٥٣]
("Indeed, Allah is with the patient." – Quran, 2:153)
হিব্রু (বাইবেল):
בְּכָל־דָּרְכֶיךָ דָעֵהוּ וְהוּא יְיַשֵּׁר אֹרְחוֹתֶיךָ – [משלי، ٣:٦]
("In all your ways acknowledge Him, and He will make your paths straight." – Bible, Proverbs 3:6)
সংস্কৃত (গীতা):
सततं कर्म करोति – [भगवद गीता, अध्याय 3 और 17]
("Perform your duty with unwavering commitment." – Gita, Chapter 3 and 17)